সেই ভোরে উঠে একসঙ্গে অনুশীলন করা, বিকেল হলেই নিজেদের মধ্যে ম্যাচ। বোর্ডিং স্কুলের মতো বাফুফে ভবনকে ভীষণভাবে আপন করে নেন প্রায় ৭০ জন নারী ফুটবলার। কত সুন্দর দিনই না ছিল তাঁদের। সাফ জয়ের পর এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার একটা তাড়না কাজ করছিল মেয়েদের মধ্যে।
কিন্তু আট মাস ধরে কোনো ধরনের ম্যাচ খেলতে না পারায় সেই হাসিখুশি ফুটবল ক্যাম্পেই একটু একটু করে হতাশা ঘিরে ধরেছে।
সারাদিন যাঁরা হৈ-হুল্লোড় করে মতিঝিলের ওই বাফুফে ভবনে কাটিয়ে দিতেন, এখন সেখানেই ঘিরে ধরেছে অবিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বোবা কান্না। মিডিয়ায় কথা বলা নিষেধ, তাই চাইলেও ভেতরের যন্ত্রণাগুলো তাঁরা সামনে আনতে পারছেন না।
আজ দুই মাস হতে চলল বেতন (বাফুফের ভাষায় সামান্য টোকেন মানি) পান না সাবিনা-কৃষ্ণারা। খুব তো বেশিও না, অধিনায়ক সাবিনা মাসে ২০ হাজার টাকা পান, বাকিরা কেউ ১৫, কেউ বা ১০ হাজার। মাসের নির্দিষ্ট সময়ে টাকাটা এলে কেউ কেউ বাড়িতে পাঠান সেই সম্মানীর একটা বড় অংশ।
তার পরও ফুটবলকে ভালোবেসে পেটে-ভাতে সারাদিন বাফুফে ভবনে থাকেন তাঁরা। কিন্তু সেই ফুটবলও যে অধরা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ১৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর গিয়ে তাদের সঙ্গে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল সাবিনাদের। কিন্তু যেহেতু সেটা কোনো টুর্নামেন্ট নয়, তাই সিঙ্গাপুর জানিয়ে দেয় সফরের খরচটা বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে।
‘ফান্ড নেই’– হাহুতাশ করে সেই সফর বাদ দিয়ে দেয় বাফুফে। তখন কথা ছিল মার্চে আরেকবার চেষ্টা করা হবে। সেই মার্চ গিয়ে এপ্রিল আসে। ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক বাছাইয়ে খেলার সুযোগ আসে বাংলাদেশের সামনে। এবারও ‘ফান্ড নেই’ বলে মিয়ানমার সফর বাতিল করেন কাজী সালাউদ্দিন। ঠিক তখন থেকেই ভেঙে পড়েন নারী ফুটবলাররা।
এর আগে এপ্রিলে ভারতীয় লিগে উড়িষ্যা দলে খেলার সুযোগ আসে সিরাত জাহান স্বপ্নার। তাঁকে সেখানে ছাড়পত্র না দিয়ে আশ্বাস দেওয়া হয় মে মাসে দেশেই শুরু হবে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। এ মাসের শেষ দিকে শুরু হওয়ার কথা ছিল সেই লিগের। সেই সম্ভাবনাও এখন নেই। ছয় দলের দুটির মালিকানা নিয়ে কথা চললেও বাকি দলের স্পন্সর মিলছে না।
অগত্যা সিরাত জাহান স্বপ্নার অবসর, গতকাল শোনা গেল সাফজয়ী দলের আরেক সদস্য আঁখি খাতুনও ক্যাম্প ছেড়ে সিরাজগঞ্জের বাড়িতে ফিরে গেছেন। মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বাড়ি গেলেও বাফুফে সূত্রেরই খবর বিয়ে করে চীনে চলে যাচ্ছেন তিনি।
সত্যি কথা বলতে কী একটা ইমেজ সংকট চলছে বাফুফেতে, যা থেকে সাফল্য এনে দেওয়া নারী ফুটবলও এড়াতে পারছে না। এমনই অবস্থায় মেয়েদের প্রিয় কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের পদত্যাগের ঘোষণা। সব কিছু নিয়ে কাজী সালাউদ্দিন বসেছিলেন সাবিনাদের সঙ্গে। তাঁদের সমস্যার কথা নাকি শুনেছেন। মেয়েরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা ম্যাচ খেলতে চান। সব শুনে সালাউদ্দিন নাকি আর কিছুদিন ধৈর্য ধরতে বলেছেন। ‘একটা ফান্ডের জন্য চেষ্টা করছি, ফান্ড পেলে সব চাহিদাই পূরণ করা হবে।’ সেই পুরোনো আশ্বাস ।
বিশ্ব ফুটবলে নারী ফুটবলকে ডেভেলপিং প্রোগ্রামের আওতাতেই রাখা হয়। সেখানে নারী ফুটবলাররা ক্লাবে খেলেই অর্থ উপার্জন করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্লাব ফুটবলের সেই ব্যবস্থা এখনও মজবুত হয়নি। তাই বাফুফে মনে করে, এই মেয়েরা তাদেরই যত্নে তৈরি করা।
সেই মেয়েরা এভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে– এটা যেন ভাবতেই পারছেন না সালাউদ্দিন। যেমনটা ভাবতে পারছেন না কোচ ছোটন কেন মিডিয়ার সামনে গিয়ে মুখ খুললেন। আসলে তিনিই চাচ্ছেন না ছোটন আবার ফিরে আসুক। তাঁকে ফেরানোর কথা বলে কোনো ফোনও করেননি। তাঁর ভরসা পল স্মলির প্রতি। অথচ সোহাগ ঘনিষ্ঠ এই পলের উস্কানিতেই নাকি মিয়ানমার সফর বাতিল করা হয়। অন্তত কিছু নারী ফুটবলারের ধারণা এমনই।
এবার নতুন করে সাবিনা-সানজিদাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে জুলাইয়ে ফিফা উইন্ডোতে মঙ্গোলিয়ায় গিয়ে দুটি ম্যাচ খেলা হবে। ‘জানি ওই সময়টা মঙ্গোলিয়ায় বেশ ঠান্ডা থাকবে। আমরা চেয়েছিলাম, ওরা যেন এখানে এসে খেলে যায়। কিন্তু ওরা আসতে চাইছে না।
তাই আমরা সেখানে গিয়ে দুটি ম্যাচ খেলব।’ নারী ফুটবল উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণের এই আশ্বাসের পরও খুব যে স্বস্তি ফিরেছে মেয়েদের মধ্যে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে এই সপ্তাহের মধ্যেই তাঁদের বেতন দিয়ে দেওয়া হবে বলে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তাতে ভরসা করতেই হচ্ছে।
সুত্র : সমকাল অনলাইন
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply