আজমিরীগঞ্জ উপজেলার ইউআরসি’র ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ না করিয়ে টাকা উত্তোলন, প্রশিক্ষণে আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষকদের সাথে অসদাচরণ, শিক্ষা উপকরণ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। নানা অজুহাতে শিক্ষকদের শিখনক্রম ও বিস্তরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ থেকে এই অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
এ নিয়ে ইতিমধ্যে শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
গত জুলাই মাসের ২৮ তারিখ এই অভিযোগ প্রদান করা হয়। অভিযোগ সুত্রে জানা যায়, ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেন মাসের বেশির ভাগ সময়ই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। বিভিন্ন সময়ে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ আসলে মোবারক হোসেন প্রশিক্ষণ করাতে অনিহা প্রকাশ করেন।
জেলার সবগুলো উপজেলায় প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলেও শুধুমাত্র আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরের গণিত অলিম্পিয়াডের দুটি ব্যাচ ও বাংলা বিষয়ের একটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ করান নি মোবারাক হোসেন। এই দুটি প্রশিক্ষণ তিনি না করিয়ে ই প্রশিক্ষণের টাকা উত্তোলন করে নিজে আত্নসাত করেন।
তাছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের গণিত অলিম্পিয়াডের চারটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ করান। কিন্তু দুটি ব্যাচের মোট ৬০ জন প্রশিক্ষণার্থীর ব্যাগ বাবদ বরাদ্দ ৫শ টাকা করে ৩০ হাজার টাকা আত্নসাত করেন।
প্রশিক্ষণের প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য প্রতি দিন সম্মানী ৫শ টাকা, প্রতিদিন নাস্তা বাবদ ৮০টাকা, ব্যাগ বাবদ ৫শ টাকা এবং প্রশিক্ষণ উপকরণ (তথ্যপত্র, পোস্টার, মার্কার পেন, সাইন পেন, প্যাড, কলম, পেন্সিল, সার্পনার, ইরেজার এবং নেমকার্ড) বাবদ ৫০০ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
কিন্তু এই বরাদ্দে ভাগ বসিয়েছেন ইনস্ট্রাক্টর মোবারাক হোসেন। মাত্র ২শ টাকা দামের ব্যাগ দিয়ে বাকি টাকা মেরে দিচ্ছেন তিনি। এছাড়াও ইন্সট্রাক্টর মোবারাক হোসেনের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণের সময় অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা, শিক্ষকদের সাথে অসদাচরণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বলে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষকরা মনে করেন, তার এই আচরণের ফলে প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান ব্যাহত হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে জানতে ইউআরসি’র ইন্সট্রাক্টর এর সাথে সরাসরি তার অফিসে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষা অফিসে শিক্ষকদের সাথে সভা থাকায় সেখানে গিয়ে উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে ইন্সট্রাক্টর মোবারাক হোসেন এর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলোর সতত্য পাওয়া যায়।
সভা চলাকালীন সময়ে একপর্যায়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার রুমেই ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেন ঢুকে পড়েন। সভায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা,সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তার সামনেই অনেক শিক্ষক তাদের প্রশিক্ষণ না করানোর কারণে ক্ষোভ জানান।
এ সময় কদমতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক মোস্তাকিম আহমেদ বলেন, বর্তমানে সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে সারা দেশে শিক্ষকদের নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। দেখলাম আশেপাশের উপজেলাতে ৩/৪ ব্যাচ করে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছেন কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম আমাদের উপজেলা।
আমরাতো প্রশিক্ষণ করতে রাজি। এসব প্রশিক্ষণ নিলে তো আমাদেরই লাভ হবে। কি কারণে এই প্রশিক্ষণ করাচ্ছেন না এটা আমাদের বোধগম্য নয়।
তিনি আরো জানান, প্রশিক্ষণের জন্য বারবার তাগিদ দিলেও ইন্সট্রাক্টর তাতে কর্ণপাত করেন নি। এমনতি তার অফিসে গিয়ে প্রশিক্ষণের কথা বললে তিনি করাবো-হবে-কিছুদিন পর বলে জানান।
এমন অভিযোগ করেন শাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নুরুল হক, নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক যাদব দেব, নূরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান চৌধুরী, বিরাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান চৌধুরীসহ অনেক শিক্ষক।
এসময় উপজেলার প্রায় ২০/২৫ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেন এর অনিয়ম ও প্রশিক্ষণ না করানোর বিষয়টি সবার সামনে তোলে ধরেন।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার ইউআরসি’র ইন্সট্রাক্টও মোবারক হোসেনের সাথে অভিযোগের বিষয়গুলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই উপজেলায় বিগত সময়ে যিনি শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন তিনি এই প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা ও সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তারা যদি প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষক না দেন তাহলে আমি কিভাবে প্রশিক্ষণ করাবো।
প্রশিক্ষণ দিতে তারা আমাকে কোন সাহায্য-সহযোগীতা করেন নি। বরং তারা প্রশিক্ষণের জন্য সম্মানি চান আমার কাছে। টাকা উত্তোলনের অধিকার আমার আছে। বিষয়ভিত্তিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রশিক্ষণের জন্য উত্তোলণকৃত সম্মানী, খাবার বিল, যাতায়াত ভাতার মোট ৪ লাখ ৭ হাজার ২শ ৮০ টাকা আমি ব্যাংকে জমা দিব।
তিনি আরো বলেন, এটা প্রশাসনের কোন বিষয় না। আমারে চালায় এডমিন ক্যাডার। আমি জেলা পিটিআই সুপারের আওতায়। একপর্যায়ে তিনি অভিযোগকারী শিক্ষকদের গর্দভ বলেও অবিহিত করেন।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে কাগজপত্র আনতে তাদেরকে খরচবাবদ টাকা দিতে হয়। তবে আমি কোন খরচাপাতি দেইনা। উপকরণ দেখতে চাইলে ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেন সেগুলো দেখাতে ব্যর্থ হন।
একফাঁকে উত্তোলনকৃত টাকা জমার করার জন্য তিনি একটি ব্যাংক চালান ফরম এই প্রতিবেদককে দেখান। যেখানে জমা দেয়ার তারিখ লেখা রয়েছে ১০/০৮/২০২৩। কিন্তু এই তারিখে তিনি উত্তোলনকৃত টাকা ব্যাংকে জমা করেননি। অভিযোগ বিষয়টি মিমাংসা না হওয়ার আগ পর্যন্ত নাকি তিনি এই টাকা জমা দিবেন না বলে জানিয়েছেন ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আজমিরীগঞ্জ উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: মজনুর রহমানের অফিসে বসে কথা হয় তার সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেন কি বললেন না বললেন সেটা আমার দেখার বিষয় না।
আমি প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষক দিতে সবসময় আগ্রহী। কিন্তু তিনি আমার কাছে আসতেই রাজি না। আর টাকা বিষয়টা একদম হাস্যকর। বাকিটা তো শিক্ষকদের উপস্থিতিতে আপনি নিজেই দেখলেন প্রশিক্ষণ না করানোর কারণে তারা কিভাবে মোবারক হোসেনের উপর বিষেধাগার করলেন।
এই বিষয়ে জানতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার গোলাম মাওলার সাথে যোগাযোগ করা হলে তা সম্ভব হয়নি। কথা হয় হবিগঞ্জ প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (পিটিআই)’র সুপারিটেনডেন্ট (সুপার) মো: কফিল উদ্দিনের সাথে। তিনি জানিয়েছেন, ইন্সট্রাক্টর মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টা আমি জানি।
অভিযোগের কপি মহাপরিচালক বরাবরে পাঠানো হয়েছে। আর আমাকেও একটা কপি দেয়া হয়েছে। যতদুর জানি মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে অচিরেই তদন্তে আসবে। আর মোবারক হোসেন তিনি একটু মানসিক ভারসাম্যহীন। উনাকে যদি এখান (তার কর্মস্থল) থেকে বদলি করা যেতো তাহলে শিক্ষকরা বেঁচে যেতেন।
বিস্তারিত জানতে প্রাথমিক শিক্ষা সিলেট বিভাগের উপ-পরিচালক জালাল উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি দৈনিক আমার হবিগঞ্জকে জানান, আমার কাছে অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ আসলে সেটা দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
এদিকে অভিযোগের অনুলিপি সিলেট বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষার বিভাগীয় উপ-পরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও হবিগঞ্জ পিটিআই’র সুপারিটেনডেন্ট বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।
Designed by: Sylhet Host BD
Leave a Reply